জাতীয়

বাজার থেকে উধাও সয়াবিন তেল

ন্যাশনাল ডেস্ক

হঠাৎই খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো কারসাজি করে এমনটি করেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। শুক্রবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাড়তি দামেও সয়াবিন তেল পাননি অনেক ক্রেতা। পবিত্র রোজা সামনে রেখে এখন থেকেই সংকট তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই পুরোনো চেনাজানা সিন্ডিকেট বাজার থেকে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে কারসাজি শুরু করেছে। মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে। এতে ডিলার থেকে খুচরা বাজারে সরবরাহ কমেছে। তাই বাড়তি দামেও চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। এতে বাজার থেকে এক প্রকার উধাওই হয়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেল। তেল না পেয়ে বিপাকে পড়ছেন ভোক্তারা। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতা ও ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে সয়াবিন তেলের সংকটের বিষয়টি জানা গেছে।

সয়াবিন তেলের এই সংকটে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। বাজার করতে আসা অনেক ক্রেতা তেল কিনতে এসে খালি হাতেই ফিরছেন। কেউ কেউ সয়াবিন তেল না পেয়ে কিনে নিচ্ছেন রাইস ব্র্যান তেল।

রাজধানীর একাধিক কাঁচাবাজারের বিভিন্ন মুদি দোকান ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত ভোজ্যতেল নেই। এক-দুই বা তিন লিটারের বোতলজাত তেল পাওয়া গেলেও পাঁচ লিটারের তেল খুবই সীমিত। অনেক দোকানি শুধু নিয়মিত ও পরিচিত ক্রেতাদের কাছে তেল বিক্রি করছেন। সংকট দেখিয়ে ভোক্তার কাছে অতিরিক্ত দাম নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে খোলা বা লুজ তেল বিক্রি করছেন অনেক দোকানি। তবে অনেক দোকানে সূর্যমুখী ও রাইস ব্র্যান তেল (চালের কুড়ার তেল) পাওয়া যাচ্ছে। সয়াবিনের সংকটে এসব তেলের চাহিদা বেড়েছে।

বাজারে খুচরা বিক্রেতারা জানান, সংকট দেখিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা পাম অয়েল ১৬০-১৬২ এবং সয়াবিন ১৭০-১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দু-একটি দোকানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিললেও বিক্রি হচ্ছে ১৬৭-১৭০ টাকায়। এছাড়া দু-এক জায়গায় এই একই তেল ১৭৫-১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

নয়াবাজারে তেল কিনতে এসেছেন মো. শাকিল। তিনি জানান, বাজার ঘুরে বোতল তেল পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে। একই বাজারে তেল কিনতে আসা আসমা বেগম বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল না পাওয়ায় রাইস ব্র্যান তেল নিয়ে বাড়ি ফিরছি।

রামপুরা বাজারে তেল কিনতে আসা মো. একরামুল হক বলেন, বাজার করতে আসা অনেক ক্রেতাই তেল কিনতে এসে খালি হাতেই ফিরছেন। কেউ কেউ সয়াবিন তেল না পেয়ে কিনে নিচ্ছেন রাইস ব্র্যান তেল। এলাকার দোকানেও তেল নেই, বাজারেও নেই। তাহলে আমরা কোথা থেকে কিনব? বেশ কয়েকদিন ধরেই সয়াবিন তেল নিয়ে এমন ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, ডিলাররা অল্প পরিমাণে সরবরাহ করছেন। চাহিদা দিয়েও অনেক কোম্পানির কাছ থেকে বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দশ কার্টন তেলের চাহিদা দিলে সপ্তাহ খানেক আগেও দুই কার্টন তেল দিত। এখন দেওয়া বন্ধ করেছে। সে কারণে খুচরা বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই এমনটা করছে। যাতে রোজার আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করতে পারে।

রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা সোহেল যুগান্তরকে জানান, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ একবারে বেশি দাম দিয়ে এক লিটারের বোতলজাত তেলও কিনতে পারছেন না। এতে খোলা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে কিছু বিক্রেতা খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় বোতলজাত তেলের মুখ খুলে খোলা তেলের ড্রামে ঢেলে বিক্রি করছেন। এতে বাজারে বোতলজাত তেলেরও সংকট দেখা দিয়েছে।

দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিভিন্ন তেল কোম্পানির ডিলাররা যুগান্তরকে জানান, কোম্পানি থেকে আমাদের তেল সরবরাহ করছে না। যেখানে একজন ডিলারের চাহিদা ১০০ কার্টন, সেখানে কোম্পানি ১০-২০ কার্টন তেল দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কমাতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামের বাজারেও ভোজ্যতেলের সংকট : শুল্ক ছাড়সহ সরকারের নানা উদ্যোগের পরও চট্টগ্রামে ভোজ্যতেলের দাম স্বাভাবিক হয়নি। দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। পাইকারি বাজার থেকে ভোজ্যতেল হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। কয়েক দিন ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ কম। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের বোতলের সরবরাহ নেই বললেই চলে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্রেতারা। বাজারটিতে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামে ভোজ্যতেল নিয়ে বড় সংকটের আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। লিটার প্রতি দাম বেড়েছে ৩-৪ টাকা পর্যন্ত। এদিকে কিছুটা কমেছে শীতকালীন সবজির দাম। মাছের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, একাধিক কারণে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। দেশে ডলার সংকট এখনও চলমান রয়েছে। আমদানিকারকরা আগের মতো ভোজ্যতেল আমদানি করছেন না। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। দেশের ইতিহাসে পাম অয়েলের দাম এবারের মতো আর বাড়েনি। মূলত ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদন সংকট, বায়োডিজেলে পাম অয়েল ব্যবহারের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধিজনিত কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির বুকিং রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোজ্যতেল নিয়ে একটি চক্র সিন্ডিকেট করে বাজারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তারা বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাজারে ভোজ্যতেলের তীব্র সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দামও হু হু করে বাড়ছে। সরকার দুই দফায় শুল্ক-কর কমিয়েও সুফল মিলছে না। বরং দাম আরও বেড়েছে।

পাইকারি বাজারে এক সপ্তাহ আগে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রতি মন সয়াবিন বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৮৭৫ টাকায়। এখন ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৯০০ টাকায়। সে হিসাবে প্রতি লিটারে দাম পড়ছে ১৭২ দশমিক ৫০ টাকা। খুচরায় লিটারপ্রতি ৪-৫ টাকা লাভ যোগ করলে বিক্রি করতে হবে ১৭৪-১৭৬ টাকায়। কিন্তু খুচরা বাজারে সরকার ও কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত সয়াবিনের লিটার প্রতি সর্বোচ্চ মূল্য ১৬৮ দশমিক ৫ টাকা। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৭৮ টাকার বেশি দরে। একই ভাবে আগস্টের প্রথম দিকে পাম অয়েলের মনপ্রতি দাম ছিল ৪ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। ওই সময়ে সয়াবিনের পাইকারি দাম ছিল মনপ্রতি ৬ হাজার  টাকার মতো।

 

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর ৩ থেকে ৪ মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।

যদিও বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে তেল সরবরাহ কমেছে বলে দাবি তেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের হিসাবে লিটারে ১০-১৩ টাকা বেড়েছে। এ জন্য চাহিদার তুলনায় আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো। তাই রিফাইনিং করে তেল বাজারে সরবরাহ কম করে দিতে হচ্ছে।

তবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়, এর প্রায় সবকটির দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহণ খরচ কমেছে। দেশে ডলারের দামও কমেছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার কিনতে হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করে। এখন তা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ১০৫ ডলার। আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১ ডলারে, সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এর দাম নিম্নমুখী। গত ডিসেম্বরের তুলনায় সয়াবিনের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি অসাধুদের জন্য তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে ও বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোজ্যতেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে। এতে প্রতিলিটার অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর ১৭-১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ, লিটারে শুল্ককর কমেছে ১০-১১ টাকা।

আর এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি মাসের ২৩ দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যাংক টার্মিনাল থেকে মোট ৬৫ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল খালাস করেছেন ব্যবসায়ীরা। আরও ৪৫ হাজার টন তেল নিয়ে চারটি জাহাজ এসেছে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button