অনুসন্ধান: মধ্যবিত্তের পাতে ইলিশ নেই কেন
ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। তবে এমন সময় বাজারে মাছটির দাম চড়। তাই মধ্যবিত্তের পাতে দেখা নেই সুস্বাদু এই মাছের। জেলেদের ভাষ্য, এই দাম বৃদ্ধি একেবারে অহেতুক নয়। এর পেছনে রয়েছে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, সাগরে ইলিশ কম ধরা পড়া, দেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব, অবৈধ জাল, দেশীয় ট্রলিং জাহাজ দিয়ে মাছ শিকার, বরফ সিন্ডিকেট, আবহাওয়ার সঙ্কেত না পাওয়ার মতো কারণগুলো।
আর আড়তদার, পাইকাররা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর মাছ কম, কিন্তু চাহিদা বেশি। তাই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ।
দাম বৃদ্ধির কারণগুলোর খোঁজ নেয় একাত্তর। কথা হয় এই পেশায় জড়িত ট্রলার মালিক থেকে শুরু করে গভীর সাগরে যাওয়া জেলেদের সঙ্গে। তাদের মুখ থেকে শোনা কথা এবং তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাচাই করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই এক সুতোয় মিলেছে। তবে কিছু জিনিস, যা গভীর সাগরে ঘটে তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সাগরে ইলিশ কম ধরা পড়ছে
বরগুনার পাথরঘাটার আবুল হোসেন ফরাজীর মালিকানাধীন এফবি ফরাজী ট্রলারের জেলে ১৮ জন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পৌনে তিন লাখ টাকার জ্বালানি, রসদ নিয়ে গভীর সাগরে যায় জাহাজটি।
১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর প্রায় এক মণ মাঝারি আকারের (৬০০-৭০০ গ্রামের) ইলিশ ও কিছু অন্য মাছ নিয়ে পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে ফিরে আসে ট্রলারটি। এক মণ ইলিশ বিক্রি করা হয় ৬০ হাজার টাকায়। অন্য মাছ আরও ১৫ হাজার টাকায়।
ট্রলারের মাঝি সুলতান মিয়া বলেন, সাগরে আগের মতো মাছ নাই। ১০ বার জাল ফেললেও মাছ কম পাই। আর বৈরি আবহাওয়া তো আছেই। ট্রলার মালিকের লোকসান দেখতে আমাদেরও ভালো লাগে না।
ইলিশ খৈল, ভুষি খায় না, যদি খেতো তবে পাঙাশের থেকেও কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারতাম
ডিজেলসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
ওই ট্রলারের মালিক আবুল ফরাজী বলেন, চলতি ইলিশ মৌসুমে এই ট্রলার আট বার মাছ শিকারে গিয়ে লোকসান হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অনেকে বলেন, ইলিশ ঘাস খায় না, খড় খায় না, খৈল, ভুষি বা ফিডও খায় না, ইলিশের জন্য চিকিৎসা খরচও নাই, ইলিশ পালতে দিনমজুরও রাখা লাগে না তারপর দাম এতো বেশি কেন?
তিনি বলেন, যদি ইলিশ এসব খাইয়ে পাওয়া যেতো তবে পাঙাশের থেকেও কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারতাম। একটি ট্রলারে একেক জন জেলের মাসিক বেতন ১৬-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। একবার সাগরে গেলে আট ব্যারেল ডিজেল দরকার হয়। এরপর জেলেদের ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যসহ ১৫ দিনে অন্তত ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ
জেলেরা জানান, ভারতীয় জেলেরা দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। একাধিকবার মৎস্য অফিস ও প্রশাসনকে জানালেও অনুপ্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পাথরঘাটার এফবি মায়ের দোয়া-৩ ট্রলারের মাঝি কাওসার হোসেন ও জেলেদের অভিযোগ, ভারতীয় অত্যাধুনিক ট্রলিং জাহাজ ও ট্রলার নিয়ে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করে। তাদের বাধা দিতে গেলে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে ভারতীয় অন্য জেলেদের ডেকে এনে আমাদের জাল-দড়ি কেটে দেয়, মারধর করে। তারা একবার ওয়াকি-টকিতে কথা বললে ৩০/৪০ টি ট্রলার চলে আসে।
এফবি নাজমা ট্রলারের মাঝি ও জেলেরা বলেন, আমরা পানি দেখে অনুমান করে মাছের আশায় জাল ফেলি। কিন্তু ভারতীয় জেলেরা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে মাছের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর যদি দেখেন সেখানে আমাদের জাল পাতা, তাহলে তারা ট্রলিং জাহাজ দিয়ে আমাদের জাল দড়ি উঠিয়ে নিয়ে মাছ শিকার করে। আমাদের ট্রলারে পাথর নিক্ষেপ করে। নৌ-বাহিনী তাদের কিছু বলে না। আমরা তাদের তথ্য দিতে গেলে উল্টো আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।
অবৈধ জালে মাছ শিকার
জেলেরা জানান, সুন্দরবনসহ আশেপাশের সব এলাকা এবং সাগরের মোহনায় খুটা জাল ব্যবহার করে কিছু অসাধু জেলে। এছাড়া সাগরে চিংড়ি মাছের জাল নামে ছোট ফাসের জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন কিছু জেলে। এসব খুটা জাল এবং ছোট ফাসের জালের কারণে ইলিশ পোণাসহ সব প্রজাতির মাছ মারা পড়ে। এ কারণে দিনের পর দিন কমছে ইলিশসহ সব প্রজাতির মাছের সংখ্যা।
দেশীয় ট্রলিং জাহাজ দিয়ে মাছ শিকার
জেলেরা জানান, ট্রলিং জাহাজ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে দিন দিন কমছে ইলিশ, বাড়ছে দাম।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের তুহিন হাওলাদারের মালিকানাধীন এফবি তুবা ট্রলারের মাঝি শার্দূল ঠাকুর (৬৮) মাছ শিকার করেন ৫০ বছরেরও বেশি সময়। তিনি বলেন, এক সময়ে সাগরে মাছ আর পানি সমান ছিল। জাল ফেললেই মাছ পেতাম। কিন্তু দিনের পর দিন মাছের সংখ্যা কমছে। মাছ কমার প্রধান কারণ হচ্ছে চট্টগ্রামের ট্রলিং জাহাজ। ইলিশ মাছ লবণ পানিতে বসবাস করলেও এরা ডিম ছাড়তে আসে মিঠা পানিতে। এসব ট্রলিং জাহাজ উপকূলের কাছাকাছি এসে মশারি জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করে। মিঠা পানিতে ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে ইলিশের পোণাগুলো যখন গভীর সাগরে যায়, তখন ট্রলিং জাহাজের মশারি জালে আটকে মারা পড়ে ইলিশ পোণা। ট্রলিং জাহাজগুলো এসব মাছ ঘাটে নেয় না। কারণ ইলিশের পোণা ধরা নিষিদ্ধ। তাই তারা ইলিশের পোণাসহ ছোট সব মাছ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে বড় মাছ নিয়ে ঘাটে যায়।
এই ট্রলারের জেলেরা জানান, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২-৩ বছরের মধ্যে সাগরে মাছের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।
বরফ সিন্ডিকেট
জেলেদের অভিযোগ, পাথরঘাটায় বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে বরফ উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই বরফের একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ৮০ টাকার এক ক্যান বরফ কিনতে হয় ১৫০ টাকায়। মাসে অন্তত ৪/৫ বার বরফ সঙ্কট হয় পাথরঘাটায়। তখন খুলনা থেকে বরফ আনতে হয়। খুলনা থেকে বরফ আনলে পরিবহন খরচসহ এক ক্যান বরফের দাম পড়ে ৬০০ টাকা। বরফের এই দাম যোগ হয় ইলিশের সঙ্গে।
আবহাওয়ার সঙ্কেত সঠিক সময়ে জানতে না পারা
অনেক জেলের অভিযোগ, সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে জাল ফেলতেই আবহাওয়া খারাপ দেখছেন। তখন বৈরি আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে ঘাটে ফিরে আসতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, একবার মাছ শিকারে সাগরে যাওয়া-আসা করতে সব মিলিয়ে অন্তত দুই লাখ টাকার ডিজেল পুড়তে হয়। কিন্তু জেলেরা সাগরে গিয়ে চলতি মৌসুমে সাত বার ফিরে এসেছে। দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটায়. অথচ এই জেলায় কোনো আবহাওয়া অফিস নেই। এখানে পূর্ণাঙ্গ একটি আবহাওয়া অফিস থাকলে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার আগেই বৈরি আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে পারতো।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবার মিটিং এ আমরা ঢাকা মৎস্য ভবনে গিয়ে নানা জটিলতার কথা লিখিতভাবে তুলে ধরি। মন্ত্রণালয়ের লোকজন থাকেন, সবাই সব কিছু জানেন, কিন্তু সমাধান হয় না।
কী বলছেন পাইকাররা
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার-পাইকাররা বলছেন, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের খোলা ডাকে ইলিশ বিক্রি করেন জেলেরা। তবে, নানা জটিলতায় বিগত বছরের থেকে এবার চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্যের বরাতে তারা জানান,
- এক কেজি ও তার বেশি ওজনের ইলিশ মণ প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকায়
- ৮০০ থেকে এক কেজির ইলিশ ৬৫-৬৯ হাজার টাকায়
- ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ ৬০-৬৪ হাজার টাকায়
- ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ ৪৫-৬৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার জিএম মাসুদ শিকদার বলেন, সিন্ডিকেট ভেঙে ইলিশের বাজার দর ঠিক রাখতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের অকশন শেডে খোলা ডাকে সরাসরি জেলেদের থেকে ইলিশ কেনেন আড়তদার ও পাইকাররা। ডাক চলাকালীন কড়া নজরদারি থাকে অকশন শেডে। এখানে কোনো ধরনের কারসাজির সুযোগ নেই।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, জেলেদের অভিযোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
তিনি জানান, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১১৮৪.৬৪ মেট্রিক টন মাছ বিক্রি হয়েছে। গত বছর এই ঘটে ১২৯৫.৯৫ মেট্রিক টন ইলিশ বিক্রি হয়েছে।