গণহত্যায় নেতৃত্বের অপরাধে রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর নিষিদ্ধের প্রস্তাব
গণহত্যার সময় কোনো বাহিনী বা দলের নিষ্ক্রিয়তার বিচার, গুম, যৌন নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করার বিধান যুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আট ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধন করে প্রস্তুত করা হয়েছে খসড়া। গণহত্যায় নেতৃত্বের অপরাধে রাজনৈতিক দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার মতো বিধানও যুক্ত করার হয়েছে প্রস্তাবিত খসড়ায়।
সোমবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে আয়োজিত মতবিনিয়ম সভায় এ প্রস্তাবনা তুলে ধরে আইন ও বিচার বিভাগ।
সভায় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সময়োপযোগী করতে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়। এতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
মতবিনিয়ম সভায় বিশিষ্টজনরা বলেন, আইনের সংশোধনী এমন হতে হবে, যেন এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। এই আইনের মাধ্যমে যেন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিপক্ষেও মতামত দিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার নিষিদ্ধ না করে নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মতামত তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী। অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ, শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দীকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ড. জাহেদুর রহমান প্রমূখ।
সভাপতির বক্তব্যে আইন উাপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, গত জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জনগণ নিজ চোখে দেখেছেন একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের একটি তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় মেতেছিল।
তিনি বলেন, আমাদের বুকের ভিতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক-এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।
তিনি বলেন, অতীতে দেখেছি, এদেশে বিচারের নামে কি ধরনের অবিচার হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।
ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বোর্ড (ট্রাইব্যুনাল)-কে পুনর্গঠন করা। আমরা এখন ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রম এখানেই থেমে থাকবে না। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের সবার মতামত নিয়ে এই আইন সংশোধন করা হবে।
আদিলুর রহমান খান বলেন, বিচারটা এমন একটা বিষয়, একদিকে প্রসিকিউশন থাকে, অন্যদিকে ডিফেন্স থাকে। সামগ্রিকভাবে বিচারটা কেমন হচ্ছে দেশের মানুষও এটা দেখে।
তিনি বলেন, আমরা এটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি পারপ্রিটেটার্সরা যেভাবে বিচার করেছে তার বাইরে সত্যিকারার্থে যেভাবে বিচার হওয়া উচিত সেভাবেই বিচার করা। ভিকটিম ফ্যামিলিও গুলোও সেটা চায়। সবার একটাই কথা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য নিয়েই আজকে আমরা একত্রিত হয়েছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যে সংশোধনী প্রস্তাবটি দেখলাম। আমরা মনে হয়েছে এটি একটি গুড ইনটেনশন নিয়ে করা হয়েছে। আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষনের দিকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। আসামিদের পাশাপাশি প্রসিকিউশনের পক্ষেও বিদেশি আইনজীবী রাখার প্রস্তাবনা এসেছে এখানে।
তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা দেখি প্রসিকিউশন টিমও ভেন্ডওভার/গেন্ডওবার হয়ে যায়। এ জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, প্রসিকিউশনের পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকেও আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ আইনে রাখা। এতে ভিকটিমের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চয়তা আসবে বলে আমি মনে করি।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ট্রাইব্যুনাল নিয়ে এর আগে যত সমালোচনা হয়েছে, সবাই মনে করেছে একাত্তরের গণহত্যার বিচার হওয়া উচিত। এখন যেভাবে সবাই মনে করছে যে, এই আন্দোলনে যারা বিভিন্ন ঘটনার শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার পাওয়া উচিত। কিন্তু ইস্যুটা ছিল যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় বিচার পরিচালনা করা হয়েছে,…দেওয়া হয়নি। এখন আমরা যে সেন্টিমেন্ট দেখছি, ভুক্তোভোগীদের বিচার পেতে হবে। আমাদের একটু অন্যভাবে বিষয়টা ভাবতে হবে। যারা অভিযুক্ত হবে তারাও যাতে ন্যায়বিচার পায়। উন্মুক্ত বিচারের যে ব্যবস্থা রাখার যে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে, সেটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। বিচারে স্বচ্ছতা আনতে অন্তত একজন আন্তর্জাতিক বিচারপতি রাখার পক্ষেও মত দেন তিনি।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত ধারার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার চেষ্টা করি তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে কবে তা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। আমার ধারণা খুজে পাওয়া যাবে না। নুরেমবার্গে সর্বশেষ হয়েছে। ২০২৪ এসে নিশ্চয়ই নুরেমবার্গ প্রয়োগ করতে যাবে না। কারণ তা এখন তা গণ্যহীন হয়ে গেছে। এখানে শুধু কয়েকজন তৃপ্তি পাবে যারা অন্য রাজনীতি করে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণের যে বিষয় বলা হয়েছে, সেখানে একটি পার্টিকুলার জিনিস এখানে মিসিং। আইনে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণ করা কথা বলা হচ্ছে। তবে এটা গ্রহণের পদ্ধতি কি হবে সেটা স্পষ্ট করা নেই।
তিনি বলেন, ডিস ইনফরমেশন আর মিস ইনফরমেশনে ভর্তি। ফেইক ভিডিও ছবি নানা ভাবে ইন্টেনশনালি ছড়াচ্ছে, আবার কেউ মোটিভেটেড হয়েও ছড়াচ্ছে। ফলে এই ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত গ্রহণের পদ্ধতি যেন একটি বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় থাকে, সেটা আইনে স্পষ্ট করাটা খুবই জরুরি।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ধারা ২০ এ রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এখান প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিষিদ্ধ কি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ একটিভিটিসকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিষিদ্ধ করা হবে। কারণ হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি রয়েছে। দেশে নিষিদ্ধ হলে দেশের বাইরে কার্যক্রম চালছে, সে ক্ষেত্রে নিষিদ্ধের এলাকা কোনটা হবে, এটা ঠিক করা হবে কিভাবে?
অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে। এখানে সবার স্ট্রং ওপেনিয়ন আছে। আমরা বলছি, অভিযুক্ত দল বা সংগঠন কিছুই করতে পারবে না। আবার পরে বলছি, যদি সে দেখাতে পারে সে কিছু ভালো কাজ করেছে, তাহলে তার শাস্তি কমাতে পারে।
তিনি বলেন, আমার মনে হয়, এই ব্যান্ডটা যদি আমরা ওভারল করি, তাহলে একটি রাজনৈতিক দলকে তার রিপেন্টেন্সের সুযোগ আমরা দিচ্ছি না, সেলফ কারেকশনের সুযোগ আমরা দিচ্ছি না। আমার একটি অল্টারনেটিভ প্রস্তাব হচ্ছে আমরা তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারি। সে ক্ষেত্রে নিবন্ধন আইন সংশোধন করতে হবে।