সাতক্ষীরা

কর্মসংস্থান ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সুযোগ এখনই

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার কে হটিয়ে তরুন ছাত্ররা নতুন রূপে বাচার অধিকার, প্রতিষ্ঠিত করার এবং স্বাধীন ভাবে কথাবলার সৃযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। সমাজের ভেতরে, রাষ্ট্রের ভেতরে যে বিভিন্ন বৈষম্য তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা দুর হয়েছে। হাজার হাজার মেধাবী সন্তানেরা বৈষম্যের কারনে চাকরি থেকে বার বার বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা অনেক লেখার ভেতরে বলেছি বিভিন্ন প্রশাসনে, সরকারী কলেজে স্কুলে এসব কারা, যারা প্রথম ও ২য় শ্রেনীর সরকারী চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে। এদের নিয়ে সমালোচনা করা ঠিক হবে না। বিভিন্ন স্কুল কলেজের ও মাদ্রাসার মেধাহীন প্রধানেরা কিভাবে চেয়ারে বসছে। আসলে ষোল আনা যখন পূর্ণ হয়ে যায় তখন পাপ বাপকেও ছাড়বেনা বা ছাড়ে না। এ মুহুর্তে মেধাহীন যে সমস্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে আছে এবং ব্যাপক দুর্নীতির সাথে ও স্বজন প্রীতির সাথে জড়িত এক্ষনে তাদের কে ছাটাই করে দেওয়া উচিত। তা না হলে যে স্বপ্ন নিয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনরত কোমলমতীর ছাত্র ছাত্রীরা অর্থনীতির চাকা কে সচল করার জন্য এবং মেধার মূল্যায়নের জন্য, বেকার সমস্যা দূর করার জন্য সামনের দিকে অকুতোভয় সাহসী সৈনিকের মত এগিয়ে যাচ্ছে তা ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হতে পারে। তাই আমাদের দাবি বিশ^ বিদ্যালয় থেকে শুধু ভি.সি, কলেজ থেকে শুধু অধ্যক্ষ বা বিভিন্ন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কারনে পদত্যাগে বাধ্যকরলে হবে না। যারা দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, ঘুষ ও দূর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত সে যেই হোক সকল আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আগে বাদ দিতে হবে এবং তাদের কে বিচারের আওতায় আনতে হবে। একবার টার্গেট করে পদক্ষেপ নিতে পারলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা জানি এ মুহুর্তে বাংলাদেশে বেকারত্ব যে কতটা প্রকট রূপ ধারণ করেছে তা জানার জন্য নীরিক্ষা, পরীক্ষা বা গবেষনার প্রয়োজন হয় না। জনশক্তি রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠান গুলোর সামনে বিদেশ গমন ইচ্ছুক মেধাবী তরুনদের ভিড় দেখলে অনুমান করা যায়। দেশে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরির ব্যবস্থা থাকলে বিদেশে যাওয়ার জন্য তরুনেরা এভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন না। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জুন মাসের ত্রৈমাসিক শ্রম শক্তি জরিপে উঠে এসেছে, দেশে এক বছরে বেকার বেড়েছে প্রায় দুই লাখ। এছাড়া গ্রাজুয়েট এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট করা বেকার তো প্রায় ছয় লাখের মত হবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুন কর্ম বাজারে যুক্ত হন। দেশীয় বাজারে খুব বেশি হলে ১০ লাখের মত কর্মসংস্থান হয়। আবার এদের মধ্যে ৮৫% মানুষের কর্মসংস্থান হয় নূন্যতম মজুরি ভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে। বাকিরা শোভন চাকরীতে যান। আর প্রতি বছর জীবন জীবিকার জন্য নূন্যতম বেচে থাকার জন্য, স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মায়ের মুখের হাসি ফোটানোর জন্য অতি ক্ষুদ্র নগন্য চাকরী নিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হৃদয়ে বাবা-মায়ের, স্ত্রী-সন্তানের ভালবাসা ত্যাগ করে পাড়ি দিতে হয় প্রবাসে। যেখানে প্রায় প্রতি বছর ১০ লাখের মতো মানুষ যান। আর বাকিদের কাজের কোন সুযোগ নেই। যেহেতু কোটা প্রথা নেই সেহেতু একই পরিবারের সবার চাকরটির সুযোগ নেই। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রায় ২ লাখের মতো বেকারের ভাগ্য বদল হতে পারে। প্রতি বছর বাংলাদেশীদের জন্য যত নতুন কর্মসংস্থান হয় তার এক তৃতীয়াংশ হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গপুর বা মধ্য প্রাচ্যের যে কোন দেশে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের দিকেও যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পথ পিচ্ছিল এখানে সরকারকে একটা কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পথ তৈরি করতে পারলে ভাল হয়। ২০০৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের চলতি মাস পর্যন্ত ভূ-মধ্য সাগর দিয়ে জীবন বাজি রেখে অনেক ঝুকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় এক লাখের মতো হবে বা এর কিছু বেশীও হতে পারে। এ থেকেই দেশের তরুনদের মধ্যে বেকারত্বের যাত্রা ধারণা করা যায়। দেশে ভালো কাজ না পেয়ে (উচ্চ ডিগ্রী থাকা স্বত্বেও) উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় গোপনে অনেকটা ঝুকি নিয়ে ভূ-মধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। আবার তাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বিদেশের কারাগারে বন্দী আমাদের তরুনদের সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে। এটাও আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। বেসরকারী গবেষন প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, “চাকরির সিংহ ভাগই তৈরি হয় বেসরকারী খাত থেকে, কিন্তু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে।” বেকারত্বের মূল কারন, যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বিগত সরকারের আমলে বড় বড় মেগা প্রকল্প হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ও সাত শতাংশের বেশী হয়েছে কিন্তু সেই তুলনায় বেসরকারী খাতের প্রসার তেমন ঘটেনি। শিল্প কল কারখানার জন্য যে অপরিহার্য বিদ্যুৎ, জ¦ালানী ও তার সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। সরকার ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বললেও বেশীর ভাগের কাজই হয়নি। অন্য দিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এতটাই সে কেলে যে, যুগের চাহিদা পূরন করতে পারছে না। বিজ্ঞান ভিত্তিক, প্রযুক্তি ভিত্তিক, কারিগরি শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা এবং সেকুল্যার ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারছি না। ফলে আমাদেরকে অনেক গুন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কর্মী আনতে হয় এবং আমাদের উচ্চ শিক্ষিত তরুনদের বেকার থাকতে হয়। বিসিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ এর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল প্রতিবেদন অনুসারে প্রায় ৪০% তরুন তরুনী শিক্ষা-কর্ম-বা প্রশিক্ষন নেই। পুরুষদের মধ্যে এ হার প্রায় ১৯%। এবং নারীদের মধ্যে এ হার প্রায় ৬১ শতাংশ। অর্থ্যাৎ বিপুলসংখ্যক তরুন তরুনী বেকার বা ছদ্ম বেকার জীবন যাপন করছেন। দেশে বেকারত্ব কমাতে হলে শিল্প ও ব্যবসা বানিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে এবং বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। গনমুখী, কর্মমুখী, বৃত্তিমূলক এবং কারিগরী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যা এ পর্যন্ত কোন সরকার করতে পারেনি বরং তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে এবং তরুণ তরুনীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা তারাই করেছে। আশাকরি বর্তমান ডঃ মোঃ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অসাধ্যকে সাধন করে আবারো ছাত্র ছাত্রীদের পাঠদানে ফিরিয়ে এনে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। অর্থনৈতিক অঞ্চল গুলো পুরোপুরি চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে যাতে কর্ম বাজারে তাদের চাহিদা থাকে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির চেয়ে কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছি সে ক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। এতদিন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যেসব সুবিধা পেয়েছি সেটা কমে যেতে পারে আবার তারা যদি আমাদের দেশে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত মনে করে সেটা বৃদ্ধি ও পেতে পারে। এ মুহুর্তে যেহেতু অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, বাগ স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সমাজ থেকে চির দিনের জন্য দূর্নীতি ও ঘুষ উৎপাটনে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তাদের পক্ষে বেকারত্ব নিরসন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দেবে এ মুহুর্তের বাংলাদেশ এটাই তাদের কাছে আশ করে।

লেখক: জহিরুল ইসলাম শাহীন
সহঃ অধ্যাপক
বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা

Related Articles

Back to top button