আর্ন্তজা‌তিক

ভারত-বাংলাদেশের মধুর সম্পর্ক এখন তেতো

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ‍্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে দুই দেশের সম্পর্ককে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,গত ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে তার উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়; যা গত কয়েক মাস ধরে জমাট বাঁধা উত্তেজনা এবার সামনে এসেছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বাংলাদেশে একজন হিন্দু পুরোহিতকে গ্রেপ্তারের পর দুই প্রতিবেশী পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ তুলেছে।

 

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের রোববারের সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

যদিও প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দূতাবাসে ভারতবাসীর হামলা এবং বাংলাদেশের পতাকার অবমূল্যায়ন বিস্তর ভাবে তুলে ধরা হয়নি।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন ৮৪ বছর বয়সী নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সরকারের আশঙ্কা হাসিনা ভারতে বসে ক্ষমতায় ফিরে আসার ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও তুলেছেন, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে ভারত।

সাম্প্রতিক চট্টগ্রামে হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে বলা হয়- এই গ্রেপ্তার উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) নামক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দুরা ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশের একটি আদালত তাকে ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন অনুযায়ী বিচারপূর্ব কারাগারে পাঠিয়েছে।

চট্টগ্রাম আদালতে চিন্ময়ের সমর্থকরা ঘেরাও করলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নিরাপত্তা বাহিনী হিমশিম খায়। এসময় এক মুসলিম আইনজীবীকে হত্যা করা হয়। ওই আইনজীবীকে কারা হত্যা করেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। পুলিশের তরফ থেকে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলে ধরার কারণে একজন ধর্মীয় নেতাকে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা দুঃখজনক। অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য দায়ীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে এমন কথা জানিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারতীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। তবে তার শাসনামলেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থাকে ভারত একটি আবেগপ্রবণ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যেন শেখ হাসিনা পতনের পরবর্তী গণআন্দোলনকে দুর্বল করা যায়।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মুক্তি না দিলে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ২০১৮ সালের পর থেকে পুলিশের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা করতেন তিনি। তবে এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন হাসিনা।

এটা ঠিক যে তার শাসনমালে কিছু মৌলবাদী শক্তিকে তিনি দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, যেগুলো তার পলায়নের পর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তবে এও সত্য যে তার আমলেও হিন্দুদের ওপর ভয়াবহ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

গত সপ্তাহে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি স্বীকার করেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে শেখ হাসিনাকে ভারতের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভারতের ‘অপপ্রচারের’ কথা উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে, ভারত থেকে ছড়ানো ‘অপপ্রচারে’ তাঁর সরকারকে চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার কথা বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

ড. ইউনূস বলেন, তিনি (হাসিনা) ভারতে আছেন। তিনি কথা বলে চলছেন। এটা পুরো দেশের জন্য কিছুটা অস্থিতিশীল ব্যাপার এবং আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলেছি, এটি ন্যায়সঙ্গত নয়। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত কাউকে আপনি জায়গা দিচ্ছেন, আর আপনি তাঁকে কথা বলতে দিচ্ছেন।

ড. ইউনূস বলেন, ভারত এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছে যে তাঁর (ড. ইউনূস) অধীন বাংলাদেশ ‘আফগানিস্তানের মতো’ হয়ে উঠছে। এটি দেশের নতুন যাত্রার কঠিন কাজকে আরও কঠিন করে তুলছে।

ড. ইউনূস বলেন, আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করেন, আপনি নিজেকে অস্থিতিশীল করবেন। কারণ, এই অস্থিতিশীলতার উপাদানগুলো আমাদের চারপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।

কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলেছেন, শেখ হাসিনা ভিন্নমতকে দমনে যে ঔপনিবেশিক যুগের আইন ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই আইনে হিন্দু পুরোহিতকে কারাগারে পাঠিয়ে ড. ইউনূসের সরকার নিজের ভালো করেনি।

শেখ হাসিনার কিছু খারাপ চর্চা, যেমন বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণ-মামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ও ‘পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাঁরা আগেও দেখেছেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সারজিস আলম বাংলাদেশে ইসকন নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসকনকে একটি ‘চরমপন্থী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এটি ‘আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ করার জন্য ভারতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।”

ইসকনের বাংলাদেশের নেতারা বলেছেন, সংগঠনটি আইন মেনে চলে। তারা আদালতের বাইরে মুসলিম আইনজীবীর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তারা প্রথমে বিবৃতি দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা তাঁর থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন।

তবে বিশ্লেষকদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকার চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করে নিজেদের অবস্থান দুর্বল করেছে। এই আইনটি শেখ হাসিনার শাসনামলেও বিরোধীদের দমন করার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button